টোবা টেক সিং (লেখক-সাদাত হাসান মান্টো)
অনুবাদে- বর্ণালী জানা সেন
দেশভাগের পরে কেটে গেছে কয়েক বছর। এবার ভারত আর পাকিস্তান… দুদেশেরই সরকারের মাথায় এক বুদ্ধি খেলে গেল। দুদেশের মধ্যে বন্দী বিনিময় তো হয়েছে এবার পাগলা গারদে যত পাগল রয়েছে তাদেরও বিনিময় করতে হবে। মানে ভারতের পাগলা গারদে যত মুসলিম পাগল আছে তাদের পাঠানো হবে পাকিস্তানে। আর পাকিস্তানের পাগলা গারদে যত হিন্দু আর শিখ রয়েছে তারা যাবে ভারতে।
এই প্রস্তাব কতটা যুক্তিসঙ্গত তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু একটা কথা পরিষ্কার…পাগল বিনিময় হবেই। দু-দেশের হোমরাচোমরা অফিসাররা অনেক বৈঠক করলেন। অনেক কথা চালাচালি হল। তারপর কথা পাকা হল। পাগল বিনিময়ের দিনক্ষণও ঠিক করা হল। তবে যেসব মুসলিম পাগলের পরিবারের লোকজন ভারতে রয়ে গেছে তাদের সেখানেই রেখে দেওয়া হবে। আর বাকিদের নিয়ে যাওয়া হবে শরহদে। সেখানেই হবে বিনিময় । পাকিস্তানে আবার এই সমস্যা নেই। দেশভাগের সময় প্রায় সব হিন্দু আর শিখ পরিবারই ভারতে চলে গেছে। তাই হিন্দু আর শিখ পাগলদের সেখানে ধরে রাখার কোনো মানে হয় না।
এই খবর শুনে ভারতে কী ঝড় উঠেছিল জানা নেই, তবে এই খবর যখন লাহোরের পাগলা গারদে পৌঁছল তখন একেবারে হইচই পড়ে গেল। সবার মুখে এই ছাড়া আর কথা নেই। একজন মুসলিম পাগল ছিল সেখানে। সে আবার ‘জমিনদার’ পত্রিকার নিয়মিত পাঠক। জ্বালাময়ী সব লেখা বেরোয় এই কাগজে। তা সেই লোককে জিগ্যেস করা হল… ‘পাকিস্তানটা কোথায়’? অনেক ভেবেচিন্তে…মাথা চুলকে সে বলে… ‘পাকিস্তান আসলে ভারতের মধ্যেই একটা জায়গা। এখানে ধারালো ক্ষুর তৈরি হয়’। তার জ্ঞানগর্ভ বাণী শুনে বাহ্ বাহ্ করে সবাই।
একপাগল শিখ অন্য এক শিখকে পাকড়াও করে তার সমস্যার কথা জানায়… ‘সর্দারজি, আমাদের কেন ভারতে পাঠানো হচ্ছে? আমি তো ওখানকার ভাষা জানি না’।
দ্বিতীয়জন মুচকি হেসে বলে… ‘আমি কিন্তু হিন্দোস্তরাসের ভাষা জানি। মুখপোড়াগুলো এমন হামবড়া ভাব দেখায় যেন সবার মাথা কিনে নিয়েছে’।
একদিন এক মুসলিম পাগল স্নান করতে ঢুকে স্লোগান দেয় ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। অতি উৎসাহে চেঁচাতে চেঁচাতে মাথা ঘুরে পড়ে মাটিতে। পরে তাকে অচৈতন্য অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
পাগলা গারদে যারা থাকে তারা সবাই যে পাগল এমনটা নয়। কেউ কেউ একেবারে স্বাভাবিক…আর পাঁচটা মানুষের মতোই। কিন্তু তারা সব খুনি-বদমাশ। ফাঁসির হাত থেকে বাঁচাতে তাদের বাড়ির লোকজন অফিসারদের ঘুস দিয়ে এখানে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ভারত কেন ভাগ হচ্ছে বা পাকিস্তান জিনিসটা আসলে কী সে বিষয়ে একটা ভাসাভাসা ধারণা তাদের রয়েছে। কিন্তু এখন যা হচ্ছে তা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না তাদের।
খবরের কাগজগুলোও কিছু বলছে না। রক্ষীদের কাছ থেকেও কিছু জানা যাচ্ছে না। কারণ কোনরকমে লিখতে পড়তে পারলেও এ বিষয়ে তারা একেবারে অজ্ঞ। তাদের কথাবার্তা আড়ি পেতে শুনেও কোনো লাভ হয়না। কেউ বলে মহম্মদ আলি জিন্না বলে একজন মানুষ আছেন। তাঁকে সবাই কায়েদ-এ-আজম বলে ডাকে। তিনি নাকি মুসলিমদের জন্য আলাদা একটা দেশ তৈরি করেছেন যার নাম পাকিস্তান।
কিন্তু পাকিস্তানটা ঠিক কোথায় তা কেউ জানে না। তাই পাগল আর আধা পাগলরা একটা ধন্দে পড়ে যায়। তারা এখন কোথায় আছে? ভারতে না পাকিস্তানে? তারা যদি ভারতে থাকে তাহলে পাকিস্তানটা ঠিক কোথায়? আর যদি পাকিস্তানেই তারাথাকে তাহলে যে দেশটা দুদিন আগে ভারত ছিল তা রাতারাতি কীভাবে পাকিস্তান হয়ে গেল!
সেদিন এক পাগল ঘর ঝাঁট দিচ্ছিল। ভারত-পাকিস্তান-পাকিস্তান-ভারত এই একঘেঁয়ে কচকচানি শুনতে শুনতে তার মাথায় সবকিছু জট পাকিয়ে যায়। হাতের ঝাঁটা…বালতি ফেলে চোঁ চাঁ করে দৌড় লাগায়। তারপর চড়ে বসে এক গাছের ডালে। সেখানে বসেই ভারত-পাকিস্তানের নানা সমস্যা নিয়ে ঝাড়া দু-ঘণ্টা বক্তৃতা দিয়ে যায়। রক্ষীরা চেঁচায়… ‘আরে নেমে আয়, নেমে আয় বলছি’। তাই শুনে সে পাগল আরো উঁচু একটা ডালে চড়ে বসে। রক্ষীরা আবার চেঁচায়… ‘নেমে আয় বলছি নাহলে কিন্তু শাস্তি হবে’। শাস্তিকে সে থোড়াই কেয়ার করে! সাফ সাফ সে জানিয়ে দেয়… ‘আমি ভারতেও থাকব না, আর পাকিস্তানেও নয়। আমি এই গাছের ডালেই থাকব’। অনেক বলে কয়ে তাকে শেষ পর্যন্ত নীচে নামানো হয়। নেমেই সে তার হিন্দু আর শিখ বন্ধুদের জড়িয়ে হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে। সে বুঝে গেছে এই বন্ধুরা তাকে ছেড়ে সব চলে যাবে ভারতে।
পাগলা গারদে ছিল এক মুসলিম রেডিও ইঞ্জিনিয়ার। এম এসসি ডিগ্রি আছে তার। বিশেষ কারো সঙ্গে মেশে টেসে না। দিনে একবার হাঁটতে বেরোয়। ভারত-পাকিস্তানের এই গল্প শুনতে শুনতে মাথায় ভূত চাপে তার। কাউকে বলা কওয়া নেই একদিন সব জামাকাপড় পুঁটলিতে ভরে সেটা এক রক্ষীর হাতে ধরিয়ে একদম উদোম গায়ে ছুট লাগায় বাগানে।
আরো একজন মুসলিম পাগল ছিল। বাড়ি তার চানিয়টে। অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের এক একনিষ্ঠ কর্মী ছিল সে। এখানে ঢুকে দিনে পনেরো ষোল বার চানের বাতিক হল তার। এক দিন হঠাৎ করে সে চানটান বন্ধ করে দিল। আর দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করল সেই নাকি মহম্মদ আলি জিন্না…মানে কায়েদ-ই -আজম। তার দেখাদেখি এক শিখ পাগলও ঘোষণা করে দিল সে নাকি শিখদের নেতা মাস্টার তারা সিং। জেলের কর্তারা তো প্রমাদ গুনলেন। এবার একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা বেঁধে যাবে না তো? তাই এই দুজনকে বিপজ্জনক ঘোষণা করে আলাদা আলাদা কুঠুরিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হল
লাহোরের একজন কমবয়সী হিন্দু উকিলও ছিল সেখানে। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে মাথাটা তার বিগড়েছে। তাকে যখন বলা হল অমৃতসর ভারতেই যাবে তখন সে আরো মুষড়ে পড়ল। তার প্রিয়তমা নাকি অমৃতসরেই থাকে। মাথা খারাপ হলে কি হবে প্রেমিকা কোথায় থাকে সেকথা সে ভোলেনি । বড়, ছোট, মেজ সব হিন্দু আর মুসলিম নেতাকে শাপশাপান্ত করে ছাড়ে সে। কারণ তারাই চক্রান্ত করে দেশটাকে দু-টুকরো করে দিয়েছে। এরাই তার প্রেমিকাকে হিন্দুস্তানি আর তাকে পাকিস্তানি করে ছেড়েছে।
এবার দুদেশের মধ্যে পাগল বিনিময়ের কথা যখন শোনা গেল তখন বন্ধুরা তো সবাই ছুটে এসে তাকে অভিনন্দনের বন্যায় ভাসিয়ে দিল। সে এবার ভারতে যেতে পারবে…প্রেমিকার সঙ্গে মিলতে পারবে। কিন্তু সে এককথায় জানিয়ে দেয়, লাহোর ছেড়ে সেযাবে না। কেননা অমৃতসরে তার পসার জমবে না।
ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডে দুজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পাগলও ছিল। একদিন তারা জানতে পারল ইংরেজরা নাকি এই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এই দেশ স্বাধীন হচ্ছে। এই কথা শুনে তারা জোর ধাক্কা খেল। সারা দুপুর ধরে একে অন্যের কানে কী যেন ফিসফিস করে গেল। তাদের একটাই চিন্তা স্বাধীনতার পরে এইঅ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ওয়ার্ডের কী হবে…সেটা কি উঠিয়ে দেওয়া হবে? এই ওয়ার্ড উঠে গেলে তাদের কি ব্রেকফাস্ট দেওয়া হবে নাকি ঐ ব্লাডি ইন্ডিয়ানগুলোর মতো চাপাটি খেয়ে থাকতে হবে?
এখানে আরো একজনও ছিল। এক শিখ। গত পনেরো বছর ধরে সে এখানেই রয়েছে। কোনো কথা বলেনা। আর বললে কতগুলো অদ্ভূত শব্দ বলে যায় যার মানে কেউ বুঝতে পারে না… ‘উপর দি গুড় গুড় দি আনেক্সে দি বে ধ্যায়না দি মুং দি ডাল অফ দ্য লালটেইন’। রক্ষীরা বলে এই পনেরো বছরে সে চোখের পাতা এক করেনি। মাঝে মাঝে দেওয়ালে হেলান দিয়ে একটু জিরিয়ে নেয়। আর বাকি সময়টা সে দাঁড়িয়েই থাকে। এইজন্যই তার পা সবসময় ফুলে থাকে। তবে এ নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। ইদানীং ভারত-পাকিস্তানের এই পাগল বিনিময়ের সব কথাবার্তা মন দিয়ে শুনছে সে। এ ব্যাপারে তার মতামত জানতে চাইলে গম্ভীর মুখে সে বলে… ‘উপর দি গুড় গুড় দি আনেক্সে দি বে ধ্যায়না দি মুংগ দি ডাল অফ দ্য গভর্নমেন্ট অফ পাকিস্তান’।
এখন আবার ‘গভর্নমেন্ট অফ পাকিস্তান’ না বলে সে বলে ‘গভর্নমেন্ট অফ টোবা টেক সিং’। পাঞ্জাবের এক ছোট্ট শহর এই টোবা টেক সিং। সেখানেই নাকি তার বাড়ি। সে জনে জনে জিগ্যেস করে বেড়ায় এই টোবা টেক সিং কোন দেশে পড়বে। কিন্তু কেউ সদুত্তর দিতে পারে না। কারণ তারা নিজেরাই ঠিক জানে না এইটোবা টেক সিং-টা ভারতে না পাকিস্তানে।
কেউ কেউ অবশ্য এই রহস্যটার সমাধান করতে এসেছিল। কিন্তু শিয়ালকোটের কথা শুনে পিলে চমকে গেল। যে শিয়ালকোট এতদিন ভারতে ছিল তা কিনা পাকিস্তানে চলে এসেছে! তাহলে লাহোরের বেলাতেও এটা হতেই পারে। লাহোরও রাতারাতি একদিন পাকিস্তান থেকে ভারতে ঢুকে যেতে পারে। আর এটাও তো হতে পারে যে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশটাই একদিন পাকিস্তান বনে গেল। আবার এই পৃথিবীর মানচিত্র থেকে ভারত, পাকিস্তান দুটো দেশই একদিন মুছে যে যাবে না সেকথাই বা কে বাজি রেখে বলতে পারে?
যাকগে সেসব কথা। এই বুড়ো মানুষটার মাথায় কোনো চুল নেই। যে কয়েকটা সাদা দাঁত এখনও টিকে রয়েছে সেগুলোও দাঁড়ির আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে। এতে তাকে দেখতে লাগে কদাকার…বীভৎস।
তবে এমনি লোকটা নিরীহ…শান্ত। কারো ক্ষতি সে করে না। কারো সঙ্গে ঝগড়া, মারামারি করতেও তাকে কেউ দেখেনি । পাগলা গারদের পুরোনো কর্মীরা বলে লোকটা নাকি টোবা টেক সিং-এর সম্পন্ন একজন জমিদার। হঠাৎ করেই মাথাটা খারাপ হয়ে যায়। পরিবারের লোকেরা ওর হাত পা বেঁধে এখানে নিয়ে আসে। তাও নয় নয় করে আজ পনেরো বছর হয়ে গেল।
আগে মাসে একবার বাড়ির লোকেরা দেখা করতে আসত। কিন্তু পাঞ্জাবে দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হওয়ার পর সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। তার নাম আসলে বিষেণ সিং। কিন্তু সবাই তাকে টোবা টেক সিং-নামেই ডাকে। চেতন আর অচেতনের মাঝামাঝি ত্রিশঙ্কুর মতো ঝুলে থাকাই এখন তার নিয়তি। কিছু মনে রাখতে পারে না সে। দিন, সপ্তাহ, মাস, বছরের সব হিসেব সে ভুলে গেছে । সে জানে না এটা কোন দিন…কোন সপ্তাহ…কোন মাস। এমনকি কত বছর সে এখানে বন্দি হয়ে রয়েছে তাও বলতে পারে না। তবে ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়টা খুব প্রখর। সে ঠিক বুঝে যেত কবে তার সঙ্গে লোকে দেখা করতে আসবে। সেদিন সে সাবান মেখে,মাথায় তেল দিয়ে চান করত, তারপর ভালো করে চুল আঁচড়ে, কাচা জামা-কাপড় পরে ফিটফাট হয়ে বসে থাকত। দেখা করতে যেই আসুক না কেন কারো সঙ্গেই সে কথা বলত না। শুধু মাঝে মাঝে মুখ থেকে বেরিয়ে যেত সেই বাঁধা বুলি… ‘‘উপর দি গুড় গুড় দি আনেক্সে দি বে ধ্যায়না দি মুং দি ডাল অফ দ্য লালটেইন’।
সে যখন প্রথম এখানে আসে তখন বড়িতে একটা ছোট মেয়ে ছিল তার। সে এখন পনেরো বছরের ঝকঝকে তরুণী। মাঝে মাঝে সে বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসত। বাবাকে এই অবস্থায় দেখে চোখের জলে ভেসে যেত সে। কিন্তু স্মৃতি-বিস্মৃতির যে জগতে তার বাবা থাকেসেখানে কাউকে আলাদা করে চিনে নেওয়া যায় না। শত শত মুখের ভিড়ে সেও একটা মুখ। এর বেশি কিছু নয়।
ভারত, পাকিস্তানের এই মহৎ পরিকল্পনার কথা শুনে আবার তার পুরোনো অভ্যেসটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। যাকে পায় তাকেই জিগ্যেস করে টোবা টেক সিং-টা ঠিক কোথায়। কেউ উত্তর দিতে পারে না। উত্তরটা যে কারোই জানা নেই।বাড়ির লোকজনের আসা-যাওয়াও বন্ধ হয়ে গেছে। মনে মনে সে ভীষণ অস্থির হয়ে ওঠে। কৌতূহল চেপে রাখতে পারেনা। যে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে বলে দিত কবে বাড়ির লোকজন আসবে সেটাও আস্তে আস্তে ভোঁতা হয়ে গেল।
বাড়ির সবার জন্য মন কেমন করে তার। বাড়ির লোকজনেরা যে জিনিসপত্র আনত…তাদের চোখে মুখে যে আন্তরিকতা ফুটে উঠত তা দেখার জন্য মন তার আকুল হয়ে থাকে। সে জানে বাড়ির লোকেরা তাকে ঠিক বলে দিত টোবা টেক সিং কোথায়? ভারতে না পাকিস্তানে? কেন জানিনা বার বার তার একটা কথাই মনে হয়যে বাড়ির লোকেরা বোধহয় টোবা-টেক-সিং-থেকেই আসে, আর তাকেও একদিন সেখানে নিয়ে যাবে।
একদিন আরেক পাগল তো মস্ত কাণ্ড করে বসে। সে নিজেকে ভগবান বলে চাউর করে দেয়। বিষেণ সিং-ও আসে ভগবানের শরণে। ভগবানের কাছে সে জানতে চায় টোবা-টেক-সিং জায়গাটা কোথায়? ভারতে না পাকিস্তানে? ভগবান মুচকি হেসে বলে… ‘ভারতেও নয়, পাকিস্তানেও নয়। আমরা এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশ জারি করিনি’। কাকুতি মিনতি করে বিষেণ সিং… ‘হে ভগবান, তাড়াতাড়ি একটা ব্যবস্থা করো…তাহলে আমার তো একটা হিল্লে হয়’। কিন্তু ভগবানের কানে কোন কথা যায় না। ভগবানের এখন অনেক জরুরি কাজ রয়েছে। রাগের চোটে বিষেণ সিং মুখঝামটা দিয়ে ওঠে… ‘উপর দি গুড় গুড় দি আনেক্সে দি বে ধ্যায়না দি মুংগ দি ডাল অফ গুরুজি দা খালসা অ্যান্ড গুরুজি কি ফতেহ…জো বোলে সো নিহাল সৎ শ্রী আকাল’।
একটা কথা সে ভগবানকে বলতে চায়… ‘তুমি তো মুসলিম ভগবান…তাই আমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছ না। তুমি যদি শিখ ভগবান হতে তাহলে এমন নিষ্ঠুর তুমি হতে পারতে না’।
পাগল বিনিময়ের দিন এগিয়ে আসে। এর মধ্যে টোবা-টেক-সিং- থেকে বিষেণ সিং-এর এক মুসলিম বন্ধু দেখা করতে আসে…পনেরো বছরে এই প্রথম। তাকে দেখামাত্রই বিষেণ সিং মুখ ঘুরিয়ে নেয়। এক রক্ষী এসে তাকে বোঝায়… ‘ ইনি তো আপনার পুরোনো বন্ধু ফজল দীন। উনি এতদূর থেকে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন’।
ফজল দীনের দিকে ভালো করে তাকায় বিষেণ সিং আর বিড়বিড়িয়ে কিছু বলতে চায়। বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে ফজল দীন বলেন… ‘অনেক দিন ধরেই এই খবরটা দেওয়ার জন্য আসব ভাবছিলাম। তোমার পরিবারের সবাই নিরাপদেই ভারতে চলে গেছে। আমি যতটুকু পারি ততটুকু সাহায্য করেছি। আর তোমার মেয়ে রূপ কাউর…সেও নিরাপদেই আছে ওখানে’।
বিষেণ সিং কোনও উত্তর করে না। ফজল দীন বলেই যান… ‘তুমি ভালো আছ কিনা সেটা তোমার বাড়ির লোক আমার কাছে জানতে চেয়েছে। আর কী বলি…আর কয়েক দিনের মধ্যে তুমিও ভারতে চলে যাবে। ভাই বলবীর সিং, ভাই ভাদহাওয়া সিং আর অমৃত কাউর বহেনকে আমার কথা বোলো। বলবীর ভাইকে বোলো যে আল্লার কৃপায় ফজল দীন ভালোই আছে। বলবীর ভাই যে দুটো বাদামি মোষ রেখে গিয়েছিলেন সে দুটোও ভালো আছে। দুটোতেই বাচ্চা দিয়েছে। তবে একটা বাচ্চা ছদিন পরেই মারা গেছে। ওদের বোলো যে ফজল ভাই সবসময় তোমাদের কথা মনে করে। ওদের চিঠি লিখতে বোলো…যদি আমি ওদের জন্য কিছু করতে পারি…ও আমি তোমার বাড়ি থেকে একটা দারুন জিনিস এনেছি’।
বন্ধুর কাছ থেকে উপহারটা নিয়ে এক রক্ষীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে জিগ্যেস করে… ‘টোবা টেক সিংটা কোথায়?’
‘কোথায় আবার…যেখানে ছিল সেখানেই আছে’।
‘ভারতে না পাকিস্তানে?’
‘ভারতে… না না পাকিস্তানে’।
আর কোন কথা না বলে বিড় বিড় করতে করতে হাঁটা লাগায় বিষেণ সিং…‘উপর দি গুড় গুড় দি আনেক্সে দি বে ধ্যায়না দি মুংগ দি ডাল অফ দা পাকিস্তান অ্যান্ড হিন্দুস্তান দূর ফিত্তে মউন’।
এদিকে জোরকদমে চলে পাগল বিনিময়ের প্রস্তুতি। দুই দেশের মধ্যে যেসব পাগলের বিনিময় হবে তাদের নামের তালিকা তৈরি করা হয়। বিনিময়ের দিনও স্থির হয়ে যায়।
এক শীতের বিকেলে হিন্দু আর শিখ পাগলদের নিয়ে লাহোর থেকে বাস রওনা হয় ওয়াঘা সীমান্তের দিকে। বাসে রয়েছে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনি…সরকারি আধিকারিকরাও আছেন। ওয়াঘায়দুপক্ষের আধিকারিকরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে নেন। দলিল-দস্তাবেজে সই সাবুদ হয়। এবার শুরু হল বিনিময়।
কিন্তু এবার শুরু হয় আসল খেল। বাস থেকে পাগলগুলোকে কিছুতেই নামানো যায় না। এক পাও নড়বে না তারা। অনেক বলে কয়ে যাদের নামানো হয় তারা উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। কেউ কেউ তো আবার উদোম গায়ে নৃত্য শুরু করে দেয়। কিছুতেই জামাকাপড় পরানো যায় না তাদের। জোর করে জামা পরালে পরমুহূর্তেই তারা সেসব ছিঁড়ে কুটিকুটি করে দেয়। কেউ আবার খিস্তিখেউড় করে…কেউ গান ধরে। কেউ ভেউ ভেউ করে কেঁদে ভাসায়। এর সঙ্গে ওর মারামারি হাতাহাতি লেগে যায়।
সব মিলে একেবারে নরক গুলজার। মেয়ে পাগলগুলো আবার এক কাঠি ওপরে। তাদের চিৎকারচেঁচামেচিতে কান পাতা দায়। বাইরে তখন কনকনে ঠান্ডা।
পাগলগুলো বুঝে পায় না এসব হচ্ছেটা কী? কেনই বা তাদের জোর করে বাসে চাপিয়ে এই অচেনা জায়গায় নিয়ে আসা হল? কেউ স্লোগান দেয়… ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’…আবার কেউ বলে ‘পাকিস্তান মুর্দাবাদ’। দুপক্ষের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়।
এবার বিষেণ সিং-এর পালা।তাকে নাম জিগ্যেস করা হয়।কারণ রেজিস্টারে সব ঠিকঠাক লিখতে হবে। সে এসে ডেস্কের পেছনে বসা অফিসারকে শুধোয়… ‘টোবা-টেক-সিং-টা কোথায়? ভারতে না পাকিস্তানে?
‘পাকিস্তানে’… বিচ্ছিরিভাবে হেসে জবাব দেয় অফিসার।
বিষেণ সিং-কে আর পায় কে? সে ছুটে পালাতে যায় পাকিস্তানের দিকে। কিন্তু পাকিস্তানের রক্ষীরা তাকে চেপে ধরে সীমান্তের ওপারে ভারতের দিকে ঠেলে দিতে চায়। কিন্তু সে এক ইঞ্চিও নড়বে না… ‘এখানেই টোবা-টেক-সিং…উপর দি গুড় গুড় দি আনেক্সে দি বে ধ্যায়না দি মুংগ দি ডাল অফ টোবা-টেক-সিং অ্যান্ড পাকিস্তান’।
সবাই মিলে তাকে কত বোঝায়… ‘শোন, টোবা-টেক-সিং ভারতে চলে গেছে। আর এখন না গেলেও খুব তাড়াতাড়ি চলে যাবে’। কিন্তু কে শোনে কার কথা। রক্ষীরা ধাক্কা দেয়, কিন্তু সে এক পাও নড়েনা। শেষমেশ তারা হাল ছেড়ে দেয়।
ফোলা পা নিয়ে দুদেশের সীমান্তের মাঝে নো-ম্যানস ল্যান্ডে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে বিষেণ সিং।
রক্ষীরা আর তাকে নিয়ে মাথা ঘামায় না। বেচারা একটা নিরীহ মানুষ! বিনিময়ের কাজ যতক্ষণ না শেষ হচ্ছে ততক্ষণ ও ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকুক। কারো তো কোন ক্ষতি হচ্ছে না। রাত কাবার হয়ে আসে।
সূর্য ওঠার ঠিক আগেই কান্ডটা ঘটে যায়। বিষেণ সিং নামে যে মানুষটা আজ পনেরো বছর ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সে হঠাৎ আর্ত চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। দুদেশের অফিসাররা তড়িঘড়ি করে ছুটে যান।
মানুষটারদুপাশে কাঁটাতারের বেড়া। বেড়ার একদিকে রয়েছে ভারত আর অন্যদিকে পাকিস্তান। আর দুপাশের বেড়ার মাঝখানেযে এক একফালি জমি রয়েছে তার কোনো নাম নেই। সেখানেই রয়েছে টোবা-টেক-সিং।
অসাধারণ।
Can I get the PDF please?
Madam PDF দেবেন? Please